মাতাপিতার সেবা জান্নাতের উসিলা (১ম কিস্তি)

বান্দার হকসমূহের বর্ণনা

আল্লামা নবভী (রহ.) তাঁর কিতাবে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করেছেন, যাতে মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার বিবরণ রয়েছে। যেমন আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, এই অধ্যায়গুলো যা ‘রিয়াযুস সালেহীন’ কিতাবে চলে এসেছে। এর সম্পর্ক বান্দার হকসমূহের মাঝে। এ যাবৎ কোন কোন আলোচনায় বান্দার হকসমূহের বর্ণনা চলেও গিয়েছে। এ হকসমূহের বিষয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য আপনারা শুনেছেন। এ নতুন অধ্যায়ে পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ এবং আত্মীয়তা সম্পর্কিত হকসমূহ আদায়ের বিষয়ে আয়াত ও হাদীস আনা হয়েছে। সর্বপ্রথম হাদীসটি হল :

উত্তম আমল কোনটি?

عن ابى عبد الرحمن عبد الله بن مسعود رض قالت : سالت النبى ص اى العمل احب الى الله؟ قال : الصلوة على وقتها، قلت : ثم اى؟ قال : بر الوالدين  قلت : ثم اى؟ قال : الجهاد فى سبيل الله
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি (নবী) বললেন, সবচেয়ে বেশি প্রিয় আমল হল সময় মতো নামায আদায় করা। আমি আবারো জিজ্ঞাসা করলাম, নামাযের পর সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি জবাবে বললেন, মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণের পর তৃতীয় নম্বরের প্রিয় আমল কোনটি? তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ (বুখারী, হাদীস নং : ৪০৫)
এ হাদীসে ধারাবাহিকতা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সবচেয়ে উত্তম ও পছন্দনীয় আমল হিসেবে সময় মতো নামায পড়াকে স্থির করা হয়েছে। দ্বিতীয় নম্বরে পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করাকে এবং তৃতীয় নম্বরে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ বা আল্লহ পথে জিহাদ করাকে ধার্য করা হয়েছে।

নেক কাজের প্রতি আগ্রহ

এখানে দু’টি কথা বুঝার আছে। প্রথমত যদি হাদীসসমূহে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তাহলে নজরে আসে, অনেক সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন স্থানে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করেছেন, সর্বোত্তম আমল কোনটি এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের এ চিন্তা এবং আগ্রহ প্রকাশিত হয় যে, তাঁরা চাইতেন, যে আমল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম এবং প্রিয় হবে তাই তাঁরা পালন করতে চেষ্টা করবেন। আর ওই আমল আমাদের যিন্দেগীতেও যেন এসে যায়। এজন্য সর্বদা তাঁদের অন্তরে ও চিন্তা-চেতনায় পরকালের ফিকির সার্বক্ষণিক চালু ছিল। তাঁরা তো চাইতেন, পরকালে কিভাবে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে। এজন্য তাঁরা সর্বদা এটা জানার চিন্তায় থাকতেন, কোন আমলে কী বিনিময় ও সওয়াব। আর তা কীভাবে আমার অর্জিত হবে?
বর্তমানে আমরা ফাযায়েলের হাদীস পড়ছি, অমুক আমালের এই ফযীলত, তমুক আমলের এই ফযীলত। পড়ি ও শুনি কিন্তু যথার্থভাবে আমলের আগ্রহ সৃষ্টি হয় না। হযরত সাহাবায়ে কেরাম (রা)-এর অবস্থা ছিল, ছোট থেকে ছোট আমলও যার সম্বন্ধে জানতেন যে, এটি সওয়াবের কাজ, তার দিকেই দৌড়াতেন।

আফসোস! আমি তো অনেক কীরাত নষ্ট করেছি

একবার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.)-এর সম্মুখে হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.)-এর এই হাদীস শুনানো হল যে, রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি আপন মুসলমান ভাইয়ের জানাযার নামাযে শরীক হবে, তবে তিনি এক কীরাত সওয়াব পাবেন। (কীরাত সে যুগের একটি পরিমাপ যন্ত্র বাটখারা ছিল। যা দ্বারা সোনা-রোপার পরিমাপ করা হত।) আর যে ব্যক্তি জানাযার নামাযের পর কবর পর্যন্ত পেছনে চলবে, তার দুই কীরাত সওয়াব হবে। আর যে ব্যক্তি দাফনেও শামিল হবে তার তিন কীরাত সওয়াব হবে। এখানে ‘কীরাত’ একটি ছোট পরিমাপক ধরা হয়েছে। কিন্তু অন্য এক হাদীসে এসেছে যে, জান্নাতের কীরাত উহুত পাহাড় থেকেও বড় হবে। 
যখন এ হাদীসটি হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) শুনালেন, তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) খুব আফসোস করে বললেন, আমি তো এ হাদীস প্রথমে শুনি নি, যে কারণে আমি বহু কীরাত সওয়াব হারিয়ে ফেলেছি।
উদ্দেশ্য ছিল, আমার ইতোপূর্বে এটি জানাই ছিল না, জানাযার নামায পড়া, পেছনে চলা এবং দাফনে শরীক হওয়াতে এমন ফযীলত রয়েছে। যদি আমার শুরুতেই জানা থাকত, তাহলে আমি এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতাম। এতে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে আমার বহু কীরাত ধ্বংশ হয়ে গেছে। অথচ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) ওই মানের সাহাবী ছিলেন, যিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের উপর আমল এবং তাঁর বিধি-বিধান মতো জীবন যাপন করতেন। যার আমলনামায় নেকীর স্তুপ মজুদ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন একটি নতুন আমল সম্পর্কে জানলেন, তখন এর প্রতি আফসোস হচ্ছিল, আমি কেন এই আমল গ্রহণ করি নি। সব সাহায়ে কেরামের এ অবস্থাই দেখা যেত, সর্বদা এ চিন্তায় মগ্ন থাকতেন, সামান্য কোন নেকী করার সুযোগও যেন হাতছাড়া না হয়, যাতে আল্লাহর কাছে বিনিময় পাওয়া যায় ও সওয়াব বৃদ্ধি হয় এবং সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.